এবিএনএ : অসহিষ্ণুতা নিয়ে মন্তব্য করায় ‘দেশদ্রোহী’ তকমা জুটেছিল আগেই। আমির খানের তুরস্ক সফর ঘিরে নতুন করে উত্তেজনার পারদ চড়ছে ভারতে। কাশ্মীর নিয়ে সাম্প্রতিককালে একাধিকবার ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। বছরের শুরুতে দিল্লিতে মুসলিমদের ওপর হামলা নিয়েও সরব হয়েছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। সম্প্রতি সেই এরদোয়ানের স্ত্রী এমিনে এরদোয়ানের সঙ্গে আমির খানের সাক্ষাতের একাধিক ছবি ও ভিডিও সামনে আসতেই তার বিরুদ্ধে সমালোচনায় মেতেছেন ভারতের কট্টরপন্থিরা।
আসন্ন অক্টোবরে তুরস্কে ‘লাল সিং চাড্ডা’ ছবির শুটিং শুরু করতে চলেছেন আমির। তার আগে কোথায় কোথায় শুটিং করা যায়, তা নিয়ে রেকি করতে গিয়েছেন তিনি। তাকে দেখে ইতিমধ্যেই হইচই পড়ে গিয়েছে সেখানকার বলিউড অনুরাগীদের মধ্যে। তার নানা ছবিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। তা নিয়ে কোনও ওজর আপত্তি না করলেও যেই না এমিনের সঙ্গে আমির খানের ছবি প্রকাশ পেয়েছে, তাতেই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে দু’মুখো বলে কটাক্ষ করেছেন কেউ কেউ। কেউ কেউ আবার তাকে ইসলামিক ভাবধারায় বিশ্বাসী বলেও উল্লেখ করেছেন। সম্প্রতি তিনি কোন কোন দেশে গিয়েছেন, কার কার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, তা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত বলেও দাবি তুলেছেন অনেকে। শনিবার ১৫ আগস্টের দিনই এই বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে। ওই দিন আমিরের সঙ্গে নিজের একাধিক ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন এরদোয়ানের স্ত্রী এমিনে। তিনি লেখেন, ‘ইস্তানবুলে বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় অভিনেতা, চিত্রনির্মাতা এবং পরিচালক আমির খানের সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হল। আমি খুব খুশি হয়েছি যে তুরস্কের বিভিন্ন জায়গায় লাল সিং চাড্ডার শুটিং করবেন বলে স্থির করেছেন আমির। আমি এখন সেদিকেই তাকিয়ে।’
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর থেকে যত দিন গড়িয়েছে তুরস্কের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে ভারতের। ২০১৭ সালে ভারত সফরে আসার আগে পাকিস্তানকে ‘মিত্র দেশ’ বলে উল্লেখ করার পাশাপাশি কাশ্মীর সমস্যায় মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দেন এরদোয়ান। সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘কাশ্মীরে আর রক্তপাত হতে দেওয়া যাবে না। বহুস্তরীয় আলোচনার মাধ্যমে এর স্থায়ী সমাধানে বার করতে আমরা আলোচনায় অংশ নিতেই পারি’। তার এই মধ্যস্থতার প্রস্তাব খারিজ করে দিল্লি। দিল্লি জানায়, কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাশ্মীরের যে অংশ পাকিস্তান দখল করে রেখেছে, তা মুক্ত করার জন্য ইসলামাবাদের সঙ্গেই আলোচনা হবে। এ নিয়ে কোনো তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা চায় না ভারত। এরপর গত বছর কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর এ নিয়ে জাতিসংঘে সরব হন এরদোয়ান। ভারতের দখলে থাকা কাশ্মীরে ৮০ লক্ষ মানুষ আটকে রয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তারপর এবছর ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে মুসলিমদের ওপর হামলার ঘটনায় মোদি সরকারকে একহাত নেন এরদোয়ান। তিনি বলেন, ‘ভারতে এখন ব্যাপক আকারে গণহত্যা হয়। কাদের গণহত্যা? মুসলিমদের। কারা করে? হিন্দুরা।’
এমন পরিস্থিতিতে আমির খানের সঙ্গে তুরস্কের ফার্স্ট লেডির সাক্ষাতের সমালোচনা করেছেন ভারতের কট্টরপন্থিরা। ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের সাংসদ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী আমিরকে কটাক্ষ করেছেন সামাজিক মাধ্যমে। বলিউডের তিন খান—শাহরুখ, সালমান এবং আমিরকে ‘থ্রি খান মাস্কেটিয়ার্স’ বলে উল্লেখ করে তাদের সম্পত্তি কীভাবে বাড়ছে, তা নিয়ে আগেই প্রশ্ন তুলেছিলেন স্বামী। দেশে-বিদেশে তাদের সম্পত্তি নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত বলেও দাবি তুলেছেন তিনি। আমির খানের ইস্তানবুল সফর নিয়ে চর্চার মধ্যে সোমবার টুইটারে সুব্রহ্মণ্যম স্বামী লেখেন, ‘আমির খানকে থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের মধ্যে এক জন বলে আমি যে ভুল করিনি, তা প্রমাণ হয়ে গেল।’
বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র লেখেন, ‘মাই নেম ইজ খান এবং আমি খলিফা শাসনে বিশ্বাস করি: আমির খান।’ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুখপাত্র শ্রীরাজ নায়ার লেখেন, ‘আমির খানের ছবি বয়কট করা উচিত। ধর্মান্ধ সাইফ যিনি বলেছিলেন ব্রিটিশরা আসার আগে ভারতের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, বয়কট করা উচিত তাকেও।’
২০১৫ সালে দেশে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা নিয়ে মুখ খোলায় আমির খানের কেরিয়ারেও তার প্রভাব পড়েছিল। ই-কমার্স সংস্থা স্ন্যাপডিল, যাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ছিলেন আমির, তারা তার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে। এমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ নিয়ে এ দিন সেই প্রসঙ্গ টেনে এনে বিজেপি মুখপাত্র সুরেশ নাখুয়া টুইটারে লেখেন, ‘আমির খান এখন কোন কোন কোন ব্র্যান্ড এনডোর্স করছেন, তা কি কারও জানা আছে? আমাকে জানান আপনারা।’
বিজেপির মুখপত্র বলে পরিচিত ‘স্বরাজ্য’ পত্রিকায় নিয়মিত যার লেখা ছাপা হয়, সেই বিকাশ সারস্বত লেখেন, ”আমার স্ত্রী কিরন রাও হিন্দু হলেও, সন্তানরা যে শুধু ইসলাম মেনেই চলবে, তা সাফ জানিয়ে দিয়েছি আমি,’ আমির খান পৌরুষ জাহির করা এক জন মানুষ নাকি মুসলিম ধর্মান্ধ, নাকি দুটোই?”
তবে গোটা ঘটনায় আমিরের পাশে দাঁড়িয়েছেন সাবেক আম আদমি পার্টি (নেতাৎ) আশুতোষ। দেশের অন্যান্য সমস্যাগুলি ধামাচাপা দিতেই খামোকা বিষয়টির রাজনীতিকরণ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। টুইটারে আশুতোষ লেখেন, ‘আমি আমির খানকে সমর্থন করি। ভুয়ো জাতীয়তাবাদীরা, যারা দেশের অর্থনীতি, করোনা পরিস্থিতি, চীনা আগ্রাসন এবং সরকারের কাজ নিয়ে কোনো আলোচনা হোক চান না, ইচ্ছাকৃত ভাবে তারা বিষয়টি নিয়ে ঝামেলা পাকাচ্ছেন।’
অক্ষয়কুমার নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাৎকার নেওয়ায়, যারা কটাক্ষ করছিলেন, তারা এখন কোথায়, এমন মন্তব্যও করেন কেউ কেউ। দু’বছর আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ভারত সফরে এলে, গোটা বলিউড তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, যার মধ্যে শামিল ছিলেন অমিতাভ বচ্চন, অভিষেক বচ্চন, ঐশ্বর্য রাই বচ্চন, কর্ণ জোহর, বিবেক ওবেরয়, প্রসূন জোশীরাও। কিন্তু আমন্ত্রণ জানানো হলেও নেতানিয়াহুর সঙ্গে দেখা করতে যাননি শাহরুখ, সালমান, আমিররা। তাদের অনুপস্থিতির কারণ ব্যখ্যা করতে গিয়ে সেইসময় বলা হয়, নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যার বিরোধিতা করতেই ওই অনুষ্ঠান থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন তারা।
তুরস্ক যেহেতু পাকিস্তানের বন্ধু, তাই আমির দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং তিনি দেশদ্রোহী বলেও মন্তব্য করেন কেউ কেউ। তবে এই প্রথম নয়। ২০১৭ সালে ‘সিক্রেট সুপারস্টার’ ছবির প্রচারে গিয়ে ২০১৭ সালে আঙ্কারায় প্রেসিডেন্ট ভবনে এরদোয়ানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন আমির। তবে স্বজনপোষণের অভিযোগে যে সময় বলিউড বিদ্ধ, ঠিক সেইসময় আমিরের এই সফর ‘লাল সিং চাড্ডা’-র উপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। হলিউড ছবি ‘ফরেস্ট গাম্প’এর হিন্দি রিমেক ‘লাল সিং চাড্ডা’। ছবিতে আমিরের বিপরীতে রয়েছেন কারিনা কাপূর খান।